আমি কীভাবে মোটা হলাম, সেই গল্পটা বলি।
আমি কীভাবে মোটা হলাম, সেই গল্পটা বলি।
বছর কয়েক আগেও আমি বেশ রোগা পটকা ছিলাম। অত্যন্ত মর্মান্তিক ছিলো সেই জীবন। সেই বেদনার কথা কাউকে খুলে বলা যায় না। একবার মিতু ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলো। আমি এতই রোগা ছিলাম, সেই ফ্যানের বাতাসে বিছানা থেকে উড়ে ফ্লোরে পড়ে গেলাম। এরপর মিতু গেলো ভয় পেয়ে। আমি বাসা থেকে বের হলে, ও আমার প্যান্টের দুই পকেটে দুইটা পেপারওয়েট ভরে দিতো। যাতে রাস্তার বাতাসে আমি উড়ে চলে না যাই। আমি কখনো লিফট মিস করতাম না। লিফটের দরজা বন্ধ হতে গিয়ে যতই সরু হোক, আমি পুট করে সেই চিপা দিয়ে ঠিক লিফটে ঢুকে যেতুম।
একবার হলো কি, আমি আর রাজীব বসে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছি। খুবই জটিল একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। আলোচনার বিষয়, প্রেম এবং সাহিত্যচর্চা। রাজীব খুব গম্ভীর গলায় বলল, যতই ওয়ার্ল্ডব্যাংকের সাহায্য আসুক, সিমেন্ট ছাড়া যেমন পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব না, তেমনি প্রেম ছাড়া সাহিত্য চর্চা সম্ভব না। প্রতিভা আপনার যাই থাকুক। প্রেমবিহীন জীবন, ভোটারবিহীন গণতন্ত্রের মতোই অর্থহীন। একটি কৈ মাছ পানি ছাড়াও বেশ কয়েক মিনিট বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু একজন মহান সাহিত্যিক প্রেম ছাড়া এক সেকেন্ডও বাঁচতে পারে না।
কথাটা বলতে বলতে রাজীবের গলা ভারি হয়ে এলো। খুবই করুণ গলায় বলল, এই ড্যাশ ড্যাশের জীবন নিয়ে কি করমু কন।
রাজীব অত্যন্ত মিষ্ট ও শুদ্ধভাষী। পারতপক্ষে সে গালি দেয় না। গালির বদলে সে বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে। যেমন, ড্যাশ ড্যাশ, ডট ডট, টুউট ইত্যাদি।
খুব সম্ভবত রাজীবের সর্দি লেগেছিলো। আলোচনার এই পর্যায়ে রাজীব আচমকা হাঁচি দিয়ে বসলো। রাজীব আমার মতোই ছোটোখাটো জীব। ওর হাঁচির জোরই বা কতটুকু। অথচ রাজীবের সেই সামান্য হাঁচির দমকে আমি বেঞ্চ থেকে ছিটকে পড়লাম চাওয়ালার উপর। চায়ের কেটলিসহ চা-ওয়ালা উল্টে পড়লো রাস্তার উপর। পুরো দৃশ্য দেখে রাজীব হতভম্ব হয়ে গেলো। সেই সময় দূঘর্টনাবশত সে আরেকটি অনিবার্য হাঁচি দিলো। আমি কারওয়ানবাজার থেকে গড়িয়ে ফার্মগেটের কাছাকাছি চলে গেলাম।
এই ছিলো আমার সরু জীবনের চিকন বেদনা।
এরপর একটি অসামান্য ঘটনা ঘটলো। আমার সাথে পরিচয় হলো জর্জিয়া নাম্মী এক নারীর। এই রূপবতী মেয়েটি থাকে আমেরিকায়। আমার লেখার দারুন ভক্ত। আমার জন্মদিন উপলক্ষে এই মেয়েটি সুদুর ভার্জিনিয়া থেকে ঢাকায় উড়ে এসেছে।
আমরা বসে আছি বনানীর এক রেস্তোরায়। জর্জিয়া লজ্জায় লাল হয়ে বলল, রবি, আমি তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি। আমি খুব ছোট চাকরি করি আমেরিকায়। ঘন্টায় ৪/ ৫ ডলার পাই। ট্যাক্স কাটার পর খুব অল্প কিছু টাকা অবশিষ্ট থাকে। আমি পুরো এক মাসের টাকা জমিয়ে তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।
সে জিনিসটি বের করলো। একটা সানগ্লাস।
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে সানগ্লাসটি চোখে দিলাম। সানগ্লাস চোখে দেয়ার ঠিক ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় টুপ করে খুলে পড়ে গেলো। সানগ্লাস সাইজে বড়ো হয়ে গেছো। জর্জিয়ার মুখ ছোট হয়ে গেলো।
সাধে কি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
এই মণিহার আমায় নাহি সাজে---
এরে পরতে গেলে লাগে,এরে ছিড়তে গেলে বাজে ।।
আমি জর্জিয়াকে সাত্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোমার ভালবাসা সাইজে আমার থেকেও বড়ো। এইটা একটা বিশাল সমস্যা। এই ভালোবাসা বহন করার সাধ্য আমার নেই।
আমার এই দার্শনিক বাণী শুনে জর্জিয়া আরও মুষড়ে পড়লো। ওর হরিণচোখে জল চলে এলো।
রূপবতী মেয়েদের চোখের জল, আর কৃষ্ণের জন্য যমুনা নদী একই ব্যাপার। মনে হয়, গলায় কলসি বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
আমিও ঝাঁপ মারা সিদ্ধান্ত নিলুম। বললুম, তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবার দাও শকতি। কথা দিলাম জর্জিয়া, আমি তোমার সানগ্লাসের মাপে বড়ো হবো।
দুনিয়া জুড়ে মানুষ শুকাতে চায়। আমি মোটা হবার সংগ্রামে নেমে পড়লাম। সামনে যা পাই, তাই খেতে লাগলাম। পিজা, পাস্তা, বার্গার, আলু, পটল, সিঙ্গারা, পুড়ি, খিচুড়ি, পোলাও, ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, কলা, কুমড়ো, তরমুজ, বাঙি, শশা, চানাচুর, ঝালমুড়ি, মিষ্টি পান, দই, রসগোল্লা, মাউথওয়াস, টুথপেস্ট, শেভিংক্রিম- সব।
অরণি তার ড্রয়িংখাতায় পেঁপের ছবি একেঁছে। সেটা দেখেও খিদা লেগে গেলো। পুরো ড্রয়িং খাতা চায়ে ভিজিয়ে সাবার করে দিলাম। এখন আমি মোটা। জর্জিয়ার সানগ্লাসে আমাকে দারুন মানায়।
Writer: Asif Emteaz Robi